মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড আমাদের কী বলছে?
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সংবিধানে ব্যক্তির জীবন, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার কথা বলা আছে। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—এই স্বাধীনতা কেবল কিছু বইয়ের পাতায় রয়ে গেছে।
পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন মানুষকে পাথর, ইট, লোহার রড দিয়ে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, যেন এটা কোনো সভ্য সমাজ না, বরং আদিম হিংস্রতার খেলা।
সোহাগ নামের সেই ব্যক্তি ছিলেন একজন সাধারণ ভাঙারি ব্যবসায়ী। তাঁর অপরাধ? চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি। তিনি চেয়েছিলেন নিজের শ্রম দিয়ে পরিবার চালাতে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা মানে হয়ে দাঁড়িয়েছে—রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে আপস করা, ভয় দেখালে মাথা নিচু করা, আর অন্যায় দেখলে চুপ থাকা।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি ব্যক্তি হত্যা নয়—এটা আমাদের সমাজের গভীরে গেঁথে থাকা রাজনৈতিক দানবের উদ্ঘাটন। যারা এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, তাদের অনেকেই একটি পরিচিত রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনের সাথে জড়িত। তারা বিশ্বাস করে— দলের নাম ব্যবহার করলে তাদের গায়ে হাত পড়বে না। তারা জানে—পেছনে কেউ না কেউ আছেই, যাদের ছত্রচ্ছায়ায় আইনও কখনও অন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের জায়গাটা অন্যখানে।
যখন এই নির্মমতা ঘটছিল, তখন আশপাশে অসংখ্য সাধারণ মানুষ ছিল। কেউ ভিডিও করেছে, কেউ দেখেছে, কেউ সমালোচনা করেছে—কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এটাই সবচেয়ে বড় পরাজয়। আমাদের নীরবতা, আমাদের গা-ঝাড়া মনোভাব, আমাদের “আমার তো কিছু হয়নি” মনোভাবই তো এই অপরাধীদের সাহস জুগিয়েছে।
প্রশ্ন একটাই—
এই দেশ কি কেবল রাজনৈতিক পরিচয়ের কাছে বিক্রি হয়ে যাবে? যেখানে দলীয় পরিচয় থাকলে খুন করাও জায়েজ? যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনের মূল্য একটা ভোটের চেয়েও কম?
আমরা ভুলে যাচ্ছি—যে রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা হরণ হয়, সেই রাষ্ট্র বেশিদিন টিকে না। যে সমাজ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, তার শেষ হয় নীরব মৃত্যুতে।
যারা আজ চুপ থেকেছেন, কাল তাদের কণ্ঠও কেড়ে নেওয়া হবে।
আজ যদি তোমরা প্রতিবাদ না কর, তবে কাল তোমাদের মৃত্যু কেউ দেখে যাবে, ভিডিও আকারে ঘুরে বেড়াবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে—আমরা শুধু সান্ত্বনার পোস্ট লিখে কাঁদব।
এই রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে—দল-মত নির্বিশেষে।
আমাদের চাই—
ব্যক্তি স্বাধীনতার সাংবিধানিক সুরক্ষা।
রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা পশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
এটা দেশ ও সমাজের জন্য শুধুমাএ কল্যান বয়ে আনবে না, কল্যান নিয়ে আসবে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও।
একটি জাতি তখনই বাঁচে, যখন তার মানুষ জেগে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যদি আমরা এখনো না জাগি, তবে পাথরের নিচে চাপা পড়ে যাবে শুধু সোহাগ নয়—চাপা পড়ে যাবে আমাদের ভবিষ্যৎ, আমাদের মানবতা, আমাদের স্বাধীনতা।
লেখা —
কচুয়া, বাগেরহাট
১১ জুলাই, ২০২৫

Comments
Post a Comment